এম আর আয়াজ রবি।
বেশ কিছুদিন যাবৎ অবুঝ মনে একটি ব্যাপার বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে, ২০১৭ সালের ২৫ শে আগষ্ট তারিখে পার্শ্ববর্তী মায়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমনের প্রায় পঞ্চম বার্ষিকী অতিবাহিত হতে চলছে, কিন্তু একজন রোহিঙ্গা অকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সেই ১৯৯০-৯১ সালের রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা সাথে ২০১৭ সালে আগত ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ঠিক যেন ম্যাচাকার অবস্থায় রয়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। বিগত ৫ বছরে বিশ্বের সর্বাধিক ‘প্রোডাকশন গ্রুথ’ বলে খ্যাত রোহিঙ্গাদের আরও প্রায় লাখ খানেক জনগোষ্ঠী যোগ হয়েছে আগত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায় দশ লক্ষাধিক ইউক্রেনীয় উদবাস্তু পার্শ্ববর্তী পোলান্ডসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেবার কারনে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর মনোযোগ নতুন ইউক্রেনীয় উদবাস্তুর দিকে ব্যস্ত থাকার কারনে পুরনো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আগের মত আগ্রহের যে ভাটা পড়বে তা বলাই বাহুল্য। ইতিমধ্যে এটার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই আগামী জুন নাগাদ নেমে নেক এনজিও, আইএনজিও তাদের আওতা কমিয়ে ফেলার কথা শুনা যাচ্ছে- যা নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, বৈ কি!
আমার চিন্তার মুল ফোকাস কিন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের মুল জনগোষ্ঠীর সাথে একাকার হয়ে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ধরে রাখার অন্তঃনিহিত বাস্তবতার দিকে!
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে উখিয়া টেকনাফ তথা কক্সবাজারে যেভাবে রোহিঙ্গা নাগরিক নির্ভীঘ্নে চলাচল করছে, এই রমযানে বিভিন্ন মসজিদে খতম তারাবি পড়ানোর জন্য রোহিঙ্গা হাফেজ নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, বিভিন্ন বাসা বাড়িতে বা দৈনিক ভিত্তিতে কাজকর্ম করার জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, বিভিন্ন হোটেলে, সুপার শপে, কলকারখানায়, বিভিন্ন বাগান বাড়িতে, বিভিন্ন প্রজেক্টে, বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে, কর্মসৃজন প্রকল্পে, ইট ভাটায়, বিভিন্ন রাস্তাঘাট তৈরি, মেরামত, গো-পালন খামার, পশু পালন প্রজেক্ট, কৃষি খামার, ধান রোপা, কাটা ও মাড়ানোসহ বিভিন্ন কাজে যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত হয়ে পড়েছে, তা দেখে আমাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের অখন্ডতা নিয়ে সচেতন মহল খুব বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
সাথে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি এবং সারা দেশের মাদ্রাসাগুলোতে বিশেষ করে কক্সবাজারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কওমী, এবতেদায়ী মাদ্রাসাসমুহে যেভাবে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের অধিক সংখ্যক অংশ গ্রহনের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে, বিভিন্ন মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছে- তারা একদিন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ঘোষনা করার উপযোগী হয়ে গড়ে উঠে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি, সামর্থ্য অর্জন যে করবে না, তা বলাই বাহুল্য।
এখানে ১৯৯০-৯১ সালে আগত রোহিঙ্গাদের প্রায় এক পঞ্চমাংশ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহন করেছে, ১৯৭৮ সালে আগত রোহিঙ্গারা তো সেই কখন থেকে রাষ্ট্রের মুল স্রোতের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে বলাই বাহুল্য! মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গাদেরকে আমরা মানবতা দেখিয়ে বা সস্তা শ্রমের মানুষ হিসেবে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে আগড়ে রেখে নিজেদের ক্ষুদ্রস্বার্থ চরিতার্থ করছি কিন্তু ঐ সমস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই পরক্ষণে আমাদের জনগোষ্ঠীর মুল স্রোতে একাকার হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাথে স্নায়ু যুদ্ধ থেকে অস্তিত্বের লড়াই শুরু করে- আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা গ্রাস করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপর বর্বরোচিত থাবা যে বসাবে না তার কোন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন?
তাই দুধ-কলা দিয়ে গোখরা সাপ পোষণ থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে। এটা নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ ও অনেক কিছু ভাবার সময় এসেছে। আলোচ্য বিষয়টি ছোট মুখে বড় কথা বলে মনে হলেও, অদূর বা দূর ভবিষ্যতে এটার রুঢ় বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে অনুভব করার সময় হবে- ঐ সময়ে আমি-আপনি হয়ত থাকব না। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম ঐ পাঁচমিশালী প্যারা থেকে নিজদেরকে রক্ষা করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। তাই আমাদের একটা অনিশ্চিত সময় নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে, যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলো-আজকের সচেতন সমাজ, সুশীল সমাজ, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক, রাষ্ট্র পরিচালক তথা বর্তমান দেশীয় জনগোষ্ঠীকে অভিসম্পাত দিতে দিতে প্রতিটি ক্ষন, মুহুর্ত, সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন,সপ্তাহ, মাস ও বছর পার করবে- এটাতে কোন ভুল নেই কিন্তু!
তাই সময় থাকতে সাধু সাবধান না হলে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সামলে নেওয়া আমাদের পক্ষে শুধু কঠিন হবে না রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে! তাই এ ব্যাপারে সচেতন সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবি, বিভিন্ন শ্রেনি পেশার মানুষকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে ঠিক তেমনি রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক মহলকে ব্যাপারটি নিয়ে সুক্ষ্মভাবে গভীর চিন্তা, উপলব্ধি, গবেষণা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা করার সময় এসেছে। ধন্যবাদ সবাইকে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ভাইস প্রেসিডেন্ট- উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া।